সাড়াজাগানো ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে ইসলাম বা বিজ্ঞানের আছে কোনো ব্যাখ্যা?
- এম আলীরেজা ; নয়াদিগন্তঃ
- ১৩ আগস্ট ২০২০, ১৯:৪১
ভবিষ্যদ্বাণীটি এখানে তুলে দেয়া হলো :
‘Rain, fame and war will not cease in Persia, too great a faith will betray with the monarch.These (actions) started in France will end there. A secret sign for one to be sparing.’
এখানে স্মরণযোগ্য : আয়াতুল্লাহ খোমেনি ফ্রান্সে নির্বাসিত হয়ে সেখান থেকেই ইসলামী বিপ্লবের নেতৃত্ব প্রদান করে শেষে বিজয়ী হন ১৯৭৯ সালে। ভবিষ্যদ্বাণীটিতে পারস্যে বা ইরানে বিপ্লব হবে ফ্রান্সে বসে- এত আগে এ ধরনের কল্পনা করাও কারো পক্ষে কখনো কি সম্ভব? অত্যাধুনিক বিশ্বের বিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তি কি এর কোনো সুরাহা করতে সক্ষম? বাস্তবে আজকের বিজ্ঞান এ ধরনের কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করার সুযোগ খোলা না রাখলেও ইতিহাস বলছে, যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা অবশ্য অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করে সফল হয়েছেন।
১২০১ সালে তৎকালীন বাংলার রাজা লক্ষণ সেন বাংলার রাজধানী নদীয়ায় অবস্থান করছিলেন। কারণ নদীয়া ছিল সবচেয়ে সুরক্ষিত অঞ্চল। রাজসভার কিছু দৈবজ্ঞ পণ্ডিত তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, এক তুর্কি সৈনিক তাকে পরাজিত করতে পারে। লক্ষণ সেন নদীয়ার প্রবেশপথ রাজমহল ও তেলিয়াগড়ের নিরাপত্তা জোরদার করেন। লক্ষণ সেনের ধারণা ছিল যে, বর্তমান ঝাড়খণ্ডের শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য দিয়ে কোনো সৈন্যবাহিনীর পক্ষে নদীয়া আক্রমণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু বখতিয়ার সে পথেই তার সৈন্যবাহিনীকে নিয়ে আসেন। নদীয়া অভিযানকালে বখতিয়ার ঝাড়খণ্ডের মধ্য দিয়ে এত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে, তার সঙ্গী মাত্র ১৮ জন সৈনিক তার সাথে তাল মেলাতে পেরেছিলেন। বখতিয়ার সোজা রাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হন এবং প্রহরীদের হত্যা করে প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করেন। এতে প্রাসাদের ভেতরে হইচই পড়ে যায় এবং লক্ষণ সেন দিগি¦দিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে পেছনের দরজা দিয়ে নৌপথে বিক্রমপুরে চলে যান। লক্ষণ সেনের দৈবজ্ঞ পণ্ডিতরা যা যা বলেন; ঠিক সে রকমটি ঘটে গেল, কিন্তু এর কি কোনো বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আদৌ সম্ভব! কিভাবে দৈবজ্ঞ পণ্ডিতরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তার চেয়ে ও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহ কোথাও সংরক্ষিত যা আমাদের কল্পনায়ও আসে না। আর আছে বলেই এরকম অনেক ঘটনা বিশ্বে ঘটেছে, যা আগেভাগে প্রকাশ সম্ভব হচ্ছে।নিম্নের ভবিষ্যদ্বাণীগুলোরও কি কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে বা দেয়া যাবে? এমনকি কাকতালীয়ভাবেও কি কোনোভাবে এরকম ভবিষ্যতের কথা বলা বাস্তবে কি কখনো সম্ভব?
বিজ্ঞানীরা যুগে যুগে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। সেসবই ছিল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানভিত্তিক যা ফলপ্রসূ হয়ে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে প্রমাণ করেছে মহাবিশ্ব সুপরিকল্পিত বা সুনিয়ন্ত্রিত হলেই কেবল এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে ঘটতে পারে। মহাবিশ্ব তাহলে নিঃসন্দেহে সুনিয়ন্ত্রিত এবং সুপরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। অবশ্যই অপরিকল্পিত সৃষ্টিতে কখনো ভবিষ্যদ্বাণী ফলপ্রসূ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
আজকের প্রচলিত বিজ্ঞান মহাবিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে কী বলে? একটা কালের অস্তিত্ব ছিল যার নাম দেয়া হয়েছে বৃহৎ বিস্ফোরণ (বিগ ব্যাং)। তখন ছিল অসীম ক্ষুদ্র মহাবিশ্ব এবং এর ঘনত্ব ছিল অসীম।
এ পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানের সব জানা বিধিই ভেঙে পড়ে। সুতরাং ভেঙে পড়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতাও।
কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণই বিপরীত। মহাবিশ্বের বৃহৎ বিস্ফোরণ আর দূরাপসারণ গতির সব ব্যাপারই শুধু সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত হলেই যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানীদের সব ভবিষ্যদ্বাণী ফলপ্রসূ হতে পারে। এটি আমরা ধারাবাহিকভাবে দেখতে পাই। অন্য দিকে তাপ গতিবিদ্যার প্রথম সূত্র বলছে : ‘এরূপ যন্ত্র তৈরি করা একেবারেই অসম্ভব, যেটি শূন্য থেকে শক্তি বানাতে পারবে এবং অবিরাম চলবে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতেই থাকবে।’ মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও বিকাশ পরিকল্পিত বিধায় এর যেকোনো বিষয়ে/পরিস্থিতিতে এটা একেবারেই অসম্ভব যে, কোনো কিছু শূন্য থেকে শক্তি উৎপন্ন করতে পারবে এবং সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিকল্পিতভাবে অবিরাম চলবে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতেই থাকবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, ঘুরে ফিরে যে বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে : বাস্তবে মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও বিকাশ পরিকল্পিত বিধায় কেবল এর যেকোনো ব্যাপারেই কোনো ভবিষ্যদ্বাণী ফলপ্রসূ হতে পারে।
বিশিষ্ট প্রাণ-পদার্থবিজ্ঞানী পাল কায়েন্স ইবারসোল্ডের মতে : ‘এই মহাবিশ্বের জন্ম সম্পর্কে বিজ্ঞান আপাত দৃষ্টিতে খুব মহাপ্লাবনিক একটি তত্ত্ব দাঁড় করাতে পারে। তারই ফলে ছায়াপথ ও নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করতে পারে। কিন্তু কোথা থেকে এই সৃষ্টির জন্য জড়পদার্থ ও শক্তি এসেছে এবং কেনই বা এই মহাবিশ্বটি এমনিভাবে গঠিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ, সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে জুটবে না।’
প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আমাদের কাছে স্পষ্ট। ভরশক্তির অবিনাশিতাবাদ তত্ত্ব বলছে, নতুন করে যেকোনো কিছু সৃষ্টি করা যেমন কখনো বিজ্ঞানে সম্ভব নয়। তেমনি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে যে, এমনকি তুচ্ছ কোনো কিছুর বিনাশও একেবারেই অসম্ভব। শুধু আছে বস্তু-শক্তির রূপান্তর, নতুন করে নেই কোনো সৃষ্টি, ধ্বংস বা বিনাশ। মহাবিশ্বের বর্তমান অস্তিত্ব প্রমাণ করে, এটি সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত বিধায় বাস্তবে বিজ্ঞান ও যুক্তি নির্ভরশীল ভবিষ্যদ্বাণী কার্যত ফলপ্রসূ হতে দেখা যায়।
(@) বৈজ্ঞানিক মেন্ডেলিফ ১৮৬৯ সালে বিজ্ঞানের সূক্ষ্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে পিরিয়ডিক টেবিলে বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের অস্তিত্ব, ধর্ম, আণবিক ওজনসহ প্রভৃতির বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, যেগুলোর অস্তিত্বের কোনো রকম ধারণাই ওই সময় পর্যন্ত কারো বিন্দুমাত্র ছিল না। বর্তমান সময় পর্যন্ত সেসব মৌলিক পদার্থ ঠিকই আবিষ্কৃত হয়েছে আর সবাই হতবাক ও বিস্মিত হয়েছে এটা দেখে যে, এই মৌলিক পদার্থগুলোর ধর্ম, গুণাবলি এবং আণবিক ওজন হুবহু মিলে যায় মেন্ডেলিফের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে : মেন্ডেলিফ রাসায়নিক পদার্থের আণবিক ওজনের জন্য শতাধিক বছরেরও বহু আগে যে পদ্ধতি তৈরি করেছেন, তার জন্য একই প্রকার ধর্মের অধিকারী মৌলিক পদার্থের সংগঠনের পর্যায়বৃত্তি বা পিরিয়ডিক টেবিলকে কেউ কি যুক্তিসম্মতভাবে শুধু আকস্মিক ব্যাপার অথবা নিছক অপরিকল্পিত বিগ ব্যাং অর্থাৎ সেই মহাবিস্ফোরণ নামের দুর্ঘটনার মতো কিছু বলে মেনে নিতে পারে?
(@) তেমনি নিউট্রিনো কণিকার অস্তিত্বের ঘোষণা দিলেন বৈজ্ঞানিক পাউলি। তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে বিটা কণিকা নির্গমনের বিষয় নিয়ে পরীক্ষা করতে কতগুলো সমস্যার উদয় হলো, যার সমাধান কোনো প্রকারেই হচ্ছিল না। এ কারণে পাউলি প্রস্তাব করলেন, বিটা নির্গমন প্রক্রিয়ায় ইলেকট্রনের সাথে নিউক্লিয়াস থেকে আরো একটি তড়িৎবিহীন ক্ষুদ্র কণিকার নির্গমন যদি ধরে নেয়া হয় তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। তিনি ১৯৩০ সালে ওই কণিকার নাম দিলেন নিউট্রিনো। তবে এর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় ১৯৫০ সালে, যখন পারমাণবিক চুল্লিগুলো নানা ধরনের কণা উৎপাদন শুরু করেছিল। এত দিন ধারণা করা হতো, নিউট্রিনো ভারবিহীন একটি কণা। কিন্তু ২০১৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী দুই বিজ্ঞানী নিউট্রিনোর রহস্য ভেদ করে প্রমাণ করেন নিউট্রিনোর ভর আছে। নোবেল কমিটি ঘোষণা দিয়েছে, কণা সম্পর্কিত পদার্থবিজ্ঞান ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে এই তাকাকি ও আর্থারের গবেষণা বড় ধরনের সাফল্য এনেছিল।
(@) একই ভাবে ঘটনাপ্রবাহে ভারবিহীন কণা ‘ভাইল ফার্মিয়ন’ এর অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর ৮৫ বছর পর ২০১৫ সালে আবিষ্কার করা হলো। ১৯২৯ সালে হারম্যান ভাইল নামের এক বিজ্ঞানী এমন একটি কণার অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। এরপর পরীক্ষাগারে চলে ব্যাপক পর্যবেক্ষণ। অবশেষে ৮৫ বছরের মাথায় বাংলাদেশী তরুণ বিজ্ঞানী জাহিদ হাসানের নেতৃত্বে একদল পদার্থবিজ্ঞানীর নিরন্তর প্রচেষ্টায় সেই কণা পরীক্ষাগারে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। ভাইল ফার্মিয়ন কণার ভর নেই। এটি ইলেকট্রনের মতো পথ চলতে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে না। এই আবিষ্কারের পর শুধু তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানই পাল্টে যায়নি, ইলেকট্রনিক ও কম্পিউটার দুনিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।
(@) মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী:
১৯২২ সালে এক যুগান্তকারী ভবিষ্যদ্বাণী ছিল আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যানের। মহাবিশ্ব সম্পর্কে তিনি দু’টি সহজ সরল অনুমান করেছিলেনঃ আমরা যেদিকেই দৃষ্টিপাত করি না কেন; মহাবিশ্বের রূপ একই রকম দেখায় এবং আমরা যদি মহাবিশ্বের কোনো স্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে মহাবিশ্বকে একই রকম দেখাবে। শুধু এ দুটো অনুমান থেকে ফ্রিডম্যান দেখিয়েছিলেন, মহাবিশ্বকে স্থির মনে করা আমাদের উচিত নয়। মূলত এটি ছিল যুগান্তকারী ভবিষ্যদ্বাণী। সাত বছর পর ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল প্রকাশ করেন যে, মহাবিশ্ব স্থিতাবস্থায় নেই। যে ছায়াপথটি যতদূরে অবস্থিত তার দূরাপসারণের গতিও তত বেশি। হাবলের এই যুগনির্দেশক পর্যবেক্ষণের অর্থ হলো, অতীত যুগেমহাবিশ্বের সব বস্তপিণ্ড পরস্পরের নিকটবর্তী ছিল। দশ কিংবা কুড়ি হাজার মিলিয়ন বছর আগে সব নীহারিকা একই জায়গায় ছিল। সুতরাং সে সময় মহাবিশ্বের ঘনত্ব ছিল অসীম। হাবলের এই আবিষ্কারই শেষে মহাবিশ্বের সূচনার প্রশ্নকে বিজ্ঞানের অঙ্গনে নিয়ে আসে।
দেশনন্দিতকথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার এক গ্রন্থে আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে সূরা আযযারিয়াতের ৪৭আয়াতটি এভাবে ভাষান্তর লিখেছেন, ''We created the heaven
with a twist of the (divine)hand. And surely we are expanding it.'' [সূরা আয জারিয়ার ৪৭ আয়াতে নভোমণ্ডল প্রসারিত হচ্ছে উল্লেখিত হয়েছেঃ‘নভোমণ্ডল নির্মাণ করেছি আমার ক্ষমতাবলে এবং আমি অবশ্যই মহাসম্প্রসারণকারী।']
বইটির ৬৩ ও ৬৪ পৃষ্ঠায় লেখক লিখেছেন ‘মহাবিশ্ব সৃষ্টি হলো বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে এবং তারপর থেকে মহাবিশ্ব ছড়িয়ে পড়ছে (ExpandingUniverse). বাস্তবে আমরা দেখছি ঐতিহাসিকভাবে আমাদের বিজ্ঞান তখন একেবারে তিমির অন্ধকারে ছিল।' এর হাজার বছরেরও অনেক পরে এটি আবিষ্কৃত হয়।
(@) ফরাসি পদার্থবিদ ডি ব্রোগলি ১৯২৪ সালে বিশ্বের বিজ্ঞানী সমাজের কাছে সনির্বন্ধ আবেদন জানিয়েছিলেন : আলোক রশ্মি হচ্ছে তরঙ্গ। কিন্তু এটা যখন পদার্থের শক্তি এবং ভরবেগ সরবরাহ করতে সক্ষম হয়, তা হলে একই যুক্তিতে আলোক রশ্মির মতো পদার্থ রশ্মিও কেন এই একই ধরনের আচরণ দেখাবে না? ওই সময় এটি ছিল তার এক যুগান্তকারী ভবিষ্যদ্বাণী। আলো তরঙ্গ, জলতরঙ্গ, বায়ু তরঙ্গ অর্থাৎ অন্য সব তরঙ্গের মতোই পদার্থও একই ‘ধর্ম’ প্রদর্শন করবে। তিন বছর পর ১৯২৭ সালে পদার্থের তরঙ্গায়িত রূপটি সর্বপ্রথম চোখে পড়ে ডেভিসন ও গারমানের পরীক্ষায়। বর্তমান সময় পর্যন্ত সব পদার্থের অণু-পরমাণুর তরঙ্গ ধর্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। আজকের কোয়ান্টাম বিজ্ঞান বলছে : কণিকা ও তরঙ্গের মধ্যে দ্বিত্ব রয়েছে। পদার্থ কার্যত তরঙ্গের স্বচ্ছ রূপ মাত্র।
ওদিকে হাজার বছরেরও অনেক আগে সূরা আন নূরের আয়াত ৩৫ বলছে, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল তথা মহাবিশ্বের সব কিছুই তরঙ্গ (নূর) বা আলো দিয়ে গঠিত।
শেষ কথা হচ্ছে, সমগ্র সৃষ্টি সুপরিকল্পিত এবং সুনিয়ন্ত্রিত বিধায় ভবিষ্যদ্বাণী ফলপ্রসূ হওয়া যুক্তিসম্মত। বিজ্ঞান সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হওয়ার একমাত্র কারণ মহাবিশ্বের সব কিছুই একটি নিয়ম এবং পরিকল্পনার আওতাধীন হওয়ায় এর বিশ্লেষণ করে এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী দেয়া সম্ভব। কিন্তু অন্যসব ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষেত্রে এই যুক্তি যথেষ্ট হতে পারে না। কিভাবে সেসব বলা বা উদঘাটন সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞান এর ব্যাখ্যা দিতে পারে না। এসব ভবিষ্যদ্বাণী ফলপ্রসূ হওয়ার পরেই এসব কিছু আসলে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী, সে কথা বলা যায়।
তবে স্বভাবতই দুই হাজার বছর আগে করোনাভাইরাসের ঘোষণা কল্পনার চোখকেও হার মানায়। এ ব্যাখ্যা এভাবেই সম্ভব হতে পারে। সৃষ্টির শুরু এবং শেষ প্রতিটি মুহূর্তের সব ঘটনাপ্রবাহ সংরক্ষিত রয়েছে। যিনি সব কিছুর স্রষ্টা, তার কাছে এটি নেহায়েত মামুলি বিষয়। এমনকি মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়ার পরও কে কী করবে, বলবে এবং কোথায় কখন কী ঘটবে/সংঘটিত হবে সবই সৃষ্টিকর্তার নখদর্পণে, সবই কিন্তু লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত। এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায় সৃষ্টিকর্তার জ্ঞান সব কিছুর ওপর থাকা স্বাভাবিক মেনে নেয়ার পরেও যে প্রশ্নটির সমাধান সহজ নয় : ২০২০ সালে গোটা পৃথিবী যে মহামারীর কবলে পড়বে, সেই পূর্বাভাস কিভাবে দেয় প্রাচীন তুর্কি ক্যালেন্ডার যিশু খ্রিষ্টের জন্মের ২০৯ বছর আগে ভাগে। এ ঘটনার বিশ্লেষণে বলা যায় : প্রকৃতির মধ্যে এমন কিছু নিদর্শন ও ইঙ্গিত মহান স্রষ্টা লুকিয়ে রেখেছেন যার রহস্য উদঘাটনের ফলেই কেবল ২০০০ বছর আগেই এই রোগের ভবিষ্যদ্বাণী কার্যত দেয়া সম্ভব হয়েছে। অন্য কোনো ব্যাখ্যা আমাদের আজকের বিজ্ঞানে ও দর্শনে কিন্তু নেই।
বিজ্ঞান পরিমণ্ডলে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা, বাস্তবে বিজ্ঞানীরা এসব ভবিষ্যদ্বাণী করেন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং তাত্ত্বিক চুলচেরা সব বিশ্লেষণের মাধ্যমে। অকাট্য বৈজ্ঞানিক যুক্তি/প্রমাণ না থাকলে এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী দেয়া কখনো সম্ভব না। বাস্তব দুনিয়ায় আমরা তখনই কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার বিষয় বা ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম, যদি মূল ঘটনা বা বিষয়টি সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এ ছাড়া ভবিষ্যদ্বাণী করার প্রশ্নই ওঠে না।
উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, একটি মহাশূন্য যানকে মঙ্গল গ্রহের মাটি, আবহাওয়া, গঠন প্রকৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য পৃথিবী থেকে পাঠানো হলো। যানটির সব যন্ত্রপাতি সেভাবে তৈরি, সন্নিবেশিত ও নিয়ন্ত্রিত করা হয়ে থাকে, যার ফলে এটি পরিকল্পিত সব কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। যানটি যেহেতু সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত তাই সহজেই এর মিশনের প্রতিটি মুহূর্তের সব খবরা খবর যেমন এটি কোথায়, কখন থাকবে এবং কী কী করবে তা আগেভাগেই বলে দেয়া সম্ভব। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, শুধু পরিকল্পিত ঘটনার ক্ষেত্রেই ভবিষ্যদ্বাণী করা যুক্তি এবং বাস্তবতাসম্মত।
একই যুক্তিতে আমাদের মহাবিশ্ব যদি সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে কেবল সে ক্ষেত্রেই যুক্তিসম্মতভাবে এর প্রতিটি কাজের ওপর ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব হবে। অতএব মহাবিশ্বের কোনো ব্যাপারে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী ফলপ্রসূ হওয়ার অর্থ দাঁড়ায়, মহাবিশ্ব নিছক দুর্ঘটনার ফসল নয় বা স্বয়ংক্রিয়ভাবেও এটি সৃষ্ট নয়।
‘নিশ্চয়ই এর পেছনে রয়েছে এক অকল্পনীয় মহাজ্ঞানী সত্তার এক রহস্যময় অভিপ্রেত। বিজ্ঞানীর দূরাভিসারী জিজ্ঞাসা সেখানে বিমূঢ় হয়ে যায়। বিজ্ঞানের চূড়ান্ত অগ্রগতিও সেখান থেকে স্তব্ধ হয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু সেই অনন্ত মহাজাগতিক রহস্যের প্রতিভাস বিজ্ঞানীর মনকে এই নিশ্চিত প্রত্যয়ে উদ্বেল করে তোলে যে, এই মহাবিশ্বের একজন নিয়ন্তা রয়েছেন। তিনি অলৌকিক জ্ঞানময়, তার সৃষ্টিকে অনুভব করা যায়, কিন্তু তাকে কল্পনা করা যায় না।’ (আইনস্টাইন)
আজকের জগতের বিজ্ঞান পরিমণ্ডলে সাম্প্রতিক সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী তোলপাড় সৃষ্টি করা সংবাদ হলো, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ বিজ্ঞানীদের মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলার ঘোষণা। মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্বের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আইনস্টাইন আজ থেকে ১০০ বছর আগে। লাইগো শনাক্তকরণ যন্ত্র এই সঙ্কেত পেয়েছে।
বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন, এটা পৃথিবীর কোনো নিজস্ব তরঙ্গ সঙ্কেত নয়, এটি হচ্ছে ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে দু’টি কৃষ্ণ গহ্বরের মিলনের ফলে সৃষ্ট মহাকর্ষ তরঙ্গেরই সঙ্কেত।
এসব ভবিষ্যদ্বাণী মূলত কিভাবে দেয়া সম্ভব? এর পরোক্ষ সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এভাবে দেয়া যেতে পারে : যিনি মহাবিশ্বের সব কিছুর স্রষ্টা, তার জ্ঞান সব কিছুর ওপরে। কারণ তিনিই তো মহান স্রষ্টা। সমুদ্রের অতল গভীরে, অরণ্যের নিভৃত কোণে, মহাকাশের নীহারিকা-ছায়াপথ সমেত প্রতিটি অঞ্চলে কোথায় কী হচ্ছে, সবই তার জ্ঞাত। এ মুহূর্তের সব খবর যেমন তিনি রাখেন, তেমনি অতীতের সব কিছু তিনিই জানেন। কোটি কোটি বছর পর ভবিষ্যতে কী হবে, তা জেনেই পরিকল্পিতভাবে তিনি এসব বানিয়েছেন। বর্ণিত আছে, তিনি আশরাফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির সেরা) মানুষকে তার ছুরতে বানিয়েছেন, আদমকে নিজের রূহ ফুঁকে দিয়েছেন আর ফেরেশতাকুল তারই নির্দেশে আদমকে সিজদা করেছে। ফেরেশতারা মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধির প্রখরতার কাছে নতিস্বীকার করে তাকে সিজদাহ করতে বাধ্য হয়েছে। স্রষ্টাই ভবিষ্যৎ জানেন।
মানুষ যেহেতু স্রষ্টারই ছুরতে তৈরি, এর ফলে মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব হওয়া অসম্ভব হয়তো কিছু নয় স্রষ্টা প্রদত্ত কিঞ্চিৎ ক্ষমতা, কৌশল ও শক্তিকে সম্ভাব্য সব প্রক্রিয়ায় কাজে লাগিয়ে কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আগেই কিছু আঁচ করা বা এর আভাস পাওয়া। ক্ষেত্রবিশেষে রূহানি শক্তিও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এ শক্তির বলে ঈসা আ:-এর খেতাব রুহুল্লাহ (আল্লাহর রূহ) এবং তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারতেন আল্লাহর কুদরতে।
বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী ছাড়া অন্য ভবিষ্যদ্বাণীর যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী ফলপ্রসূ হওয়ার কার্যকারণ একটি : মহান স্রষ্টা তার সৃষ্টির মধ্যে এমন কোনো সুযোগ রেখেছেন কেবল যার ফলে এটি সম্ভব হচ্ছে। মানুষ যেমন নতুন করে কিছু বানাতে বা ধ্বংস করতে সক্ষম নয় তেমনি প্রকৃতির কোনো নিয়ম পাল্টাতে একেবারেই অক্ষম। বর্ণিত আছে, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মানুষ শুধু প্রকৃতির ইচ্ছার কাছে (ইসলামের অর্থ আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ) মাথানত করতে বাধ্য। মহাবিশ্বের সব কিছুই আত্মসমর্পিত হয়ে একটি নির্ধারিত নিয়মরীতি অনুসরণ করছে এবং সেভাবেই চলছে। নির্ধারিত নিয়মে মহাবিশ্বের সবই আবর্তিত হচ্ছে- এর অর্থ দাঁড়ায়, এ সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী যুক্তিসম্মত। তবে এ কথা বা বিষয়টি স্পষ্ট, কোনো ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী হলে সেটি ফলপ্রসূ হওয়ার পরই এটি আমাদের বিশেষ নজরে পড়ে। শেষ জামানা সম্পর্কে শেষ নবী সা:-এর অনেক ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। সময় যতই এগিয়ে যাচ্ছে এসবের আলামতও ধারাবাহিকভাবে ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
শেষ নবী সা:-এর ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হচ্ছে :
১. সময় খুব দ্রুত বয়ে যাবে (বুখারি, মুসলিম ও আহমাদ)।
এ কথাটির অর্থ ও তাৎপর্য হচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন ও সামাজিক জীবনে কর্মব্যস্ততার পরিধি এত বেড়ে যাবে যে, মনে হবে, সময় যেন দ্রুত চলে যাচ্ছে। আগের মানুষের গড় আয়ু অনেক কম হলেও জীবনের সময়কে তারা উপভোগ করে ধীরে ধীরে ব্যবহার করেছে। আধুনিক জীবনযাত্রায় গড় আয়ু অনেক বৃদ্ধি পেলেও সময়ের সাথে প্রতিযোগিতায় মানুষ দিশেহারা। প্রতিদিনের রুটিন কাজের মধ্যে রয়েছে হরেক রকমের বাড়তি কাজ। প্রতিদিনের কাজ যেন বেড়েই চলছে। ফলে প্রত্যেকেরই মনে হয়, যেন সময় হু হু করে চলে যাচ্ছে যেটি অতীতকালে অনুভূত হয়নি। সম্প্রতি দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত একটি বক্তব্য দেখলে মনে হবে যেন, তা আমাদের সবারই অনুভূতির প্রতিধ্বনি।
জনৈক চিন্তাবিদ লিখেছেন : ‘দিনগুলো যেন খুব তাড়াতাড়ি ফুরাচ্ছে আজকাল। বছরগুলোও চোখের পলকে চলে যাচ্ছে। এই সে দিন গেল জন্মদিন, এখনো চুপসানো বেলুন দেয়ালে ঝুলে আছে; আর এখনই কি না আরেক জন্মদিন চলে এলো। আগে দিন ফুরাতো না। ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠব; তখন কবে উঠব কবে উঠব করি, দিন যায়, মাস যায় কিন্তু বছর তবু যায় না।’ সময় যে পাল্লা দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে এই অনুভূতিটি সবার ভেতরেই প্রবলভাবে কাজ করছে। ভাবতে অবাক লাগে, এ ভবিষ্যদ্বাণীটি কত আগে দেয়া হয়েছিল।
২. দাসী প্রভুর জন্ম দেবে : অর্থাৎ সন্তানরা মায়ের সাথে ক্রীতদাসীর মতো আচরণ করবে।
পৃথিবীর সব দেশে এমনকি উন্নত বিশ্বেও, সন্তানদের এই প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি জাতীয় টিভির অনুষ্ঠানে সে সমাজেও এমনটি ঘটছে- সে বিষয়টির ওপর পরোক্ষভাবে আলোকপাত করতে দেখেছি।
৩. মসজিদগুলো ভীষণভাবে সুসজ্জিত হবে।
আজকাল মসজিদের নিছক সাজসজ্জার প্রতি নজর মাত্রাতিরিক্ত।
৪. সম্পদের প্রাচুর্য এতটাই বৃদ্ধি পাবে যে, জাকাত নেয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে।
যখন লোকেরা বড় বড় দালান তৈরি করতে একে-অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লেগে যাবে। ‘যখন দেখবে, মরুভূমির রাখালরা বড় বড় অট্টালিকা তৈরির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে গেছে।’ বিশ্বের সব দেশেই এখন সম্পদের প্রাচুর্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
৫. আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘কেয়ামতের আগে যখন যেনা ও নগ্নতা বেড়ে যাবে, তখন উদ্ভট রোগ আসবে তাদের ওপর, যে রোগের নাম তাদের বাপ-দাদারাও শুনেনি।’
বর্তমানে করোনা ছাড়াও অনেক ধরনের রোগের বিস্তার কিন্তু ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলছে।
লেখক : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক।
No comments:
Post a Comment