Wednesday, January 18, 2017

যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো হলো


নয়া দিগন্ত
১৪ জুলাই ২০১৬,বৃহস্পতিবার,
যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো হলো
                                                                                                           মুহাম্মদ আলী রেজা
জন্মলগ্ন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচন ও রাজনীতি ইহুদি লবি প্রভাবিত এবং বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত। বুশ যখন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলেন, সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বড় ধরনের এক অঘটন ঘটে যায়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আলগোর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কট্টর ইহুদি লিবারম্যানকে মনোনীত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন অখ্রিষ্টান প্রার্থী হন। নিশ্চিতভাবে আমেরিকান ইহুদিদের সব ভোট আলগোরের পাল্লায় যাচ্ছে। আর এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার একটি মাত্র পথ অবশিষ্ট ছিল : ইহুদিদের ভোটের বিপরীতে সব আমেরিকান মুসলিমদের ভোট। আর ঠিক এই সময়ে হোয়াইট হাউজে চাঁদ-তারা পতাকা ওঠানো হয়েছে। স্বাধীনতার পর হোয়াইট হাউজে খ্রিষ্টান ও ইহুদি এ দুই ধর্মের পতাকা উড়ত। কারণ তারা সংখ্যায় অনেক ছিল। দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে ইহুদিদের সংখ্যা টপকে যায় মুসলমানেরা। সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত হয় এখন থেকে তিন ধর্মের পতাকা উড়বে হোয়াইট হাউজে। আবার সে সময় এখানকার মিডিয়ায় একটি ঝড় বয়ে যাচ্ছিল : যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত সম্প্রসারণশীল ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। জন হপকিন্স যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় মেডিক্যাল রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয়। বাল্টিমোরে এর দু’টি ক্যাম্পাস। আমি হোম উড ক্যাম্পাসে গবেষণা করছি। এখানে লাইব্রেরির বেসমেন্টের দেয়ালে একটি নিউজ আমার দৃষ্টিতে আসে। প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে ১০০ হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করছেন। বাইরে এসে পরে জানতে পারি, পুরুষদের চেয়ে মহিলারা বেশি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। 'Daughters of Another Path' by Carol Anway 1996 বইটি হাতে পাই। দেখতে পাই এ বইটিতে ফুটে উঠেছে আমেরিকান রমণীদের ইসলাম গ্রহণের কথামালা। বইটি এত জনপ্রিয় যে, সাথে সাথে ফ্রেঞ্চ ভাষায় ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত হয়। ইন্টারনেটে একটি মেয়ে লিখেছেন ‘বইটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি। এ তো আমারই কথা। প্রথমে আব্বা-আম্মাকে পড়তে দিয়ে বলি, এ বইতে পাবে কেন আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছি।’ বইটি আমার এত ভালো লেগেছিল যে, ঠিক করলাম অনুবাদ করব। এসে দেখি ২০০০ সালেই বইটি বাংলায় ঢাকা থেকে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইট। বইটিতে আছে আমেরিকান মেয়েরা কেন তাদের এত দিনকার খ্রিষ্টীয় পরিবেশ ছেড়ে পছন্দ করছে ইসলামকে। যে ধর্মে আছে শৃঙ্খলা, আত্মসমর্পণ ও ভিন্নরূপ হওয়ার বিধান।
আমেরিকায় দ্রুত বেড়ে চলা ধর্ম হওয়ায় মুসলমানদের সমাজে বিব্রত অবস্থায় ফেলতে বা কোণঠাসা করার মানসে তখন আইনে প্রয়োগ করা হয় Secret evidence। এই গোপনীয়তার সুযোগ নিয়ে মুসলমানদের জেলে ঢোকানো হতো। আর এই Secret evidence--এর প্রয়োগ শুধু মুসলমানদের বেলায় দেখা যেত। এখানকার সব আমেরিকান মুসলিমদের একমাত্র দাবি ছিল এটির অবসান। বুশের নির্বাচনে জেতার জন্য দরকার ছিল মুসলিম ভোট। তিনি এ সুযোগটি কাজে লাগান। আলগোরের সাথে জাতীয় নির্বাচনী বিতর্কে তিনি জোর দিয়ে বলেন, সিক্রেট এভিডেন্সকে তিনি ডিসক্রিমিনেটরি ( বৈষম্যমূলক) মনে করেন। আলগোর জবাবে বললেন, তিনি তা মনে করেন না। বাস্তবে ঐতিহাসিকভাবে কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জাতীয় নির্বাচনী বিতর্কে এই প্রথম মুসলমানদের দিকে কথা বললেন। তার বিনিময়ে আমেরিকান মুসলমানেরা এক জোট হয়ে সক্রিয়ভাবে নির্বাচনে বুশের প ল্লায় ভট দেন। দরজায় কড়া নেড়ে শেষে ইহুদি লবির বিপরীতে বুশকে বিজয়ী করেন। আগে মুসলমানেরা ব্যক্তিগত পছন্দ অনুসারে ভোট দিতেন; জোটবদ্ধভাবে এক পাল্লায় এবারই প্রথম। নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে ইনভেস্টরস ডেইলি এক নিবন্ধে মন্তব্য করে : আমেরিকান মুসলমানদের জন্য এটা বিজয়ের চেয়ে বেশি ছিল।
মুসলিম আমেরিকান ভোটে বিজয়ী বুশ উপলব্ধি করলেন এভাবে চললে একদিন মুসলমানেরা ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটব্যাংকই মূল । দ্রুত বেড়ে ওঠা ধর্ম ইসলামকে ঠেকাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।
ডেভিড গোল্ডস্টেইন কানাডার মন্ট্রিল থেকে প্রকাশিত ‘দ্য গেজেট’ পত্রিকায় টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জন্য খোদ বুশকে দায়ী করে বিন লাদেনকে বেকসুর খালাস দিয়ে বাস্তবসম্মত যুক্তি উপস্থাপন করে বলেন : এ কাজ বিন লাদেনকে দিয়ে সম্ভব নয়। বুশের অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি ইসলামকে নির্মূল করা। আর সে কারণে তার প্রথম ভাষণে ক্রুসডের ডাক দিয়েছিলেন।
হলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা চার্লিশি বলেছিলেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন ভবনে ৯/১১-র তাণ্ডব চালিয়েছে। ২০ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য এক চলচ্চিত্রে এই হামলার অষ্টম বার্ষিকীর প্রাক্কালে এ দাবি করেন। নিরপে তদন্তের জন্য ও সোচ্চার হওয়ার জন্য মার্কিন জনগণের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।
কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতে ৯/১১-এর ঘটনা ছিল একটি ষড়যন্ত্র। বিশ্বের মানুষকে এ ঘটনা দিয়ে ধোঁকা দেয়া হয়েছে। বিমানের যাত্রী ও ক্রুদের মৃতদেহ পাওয়া গেলে ডিএনএ পরীার মাধ্যমে তাদের অবশ্যই শনাক্ত করা হতো।
জাতিসঙ্ঘের ৬৫তম অধিবেশনে ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ বলেন- ৯/১১ একটি মিথ্যা ঘটনা। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অন্যতম অজুহাত। এ হামলা ছিল গোয়েন্দা সংস্থার জটিল দৃশ্যকল্প ও কর্মকাণ্ড।
যুক্তরাষ্ট্রের উটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক স্টিভেন জেন্সের নেতৃত্বে ৭৫ জন শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীর অভিযোগ: নিউ ইয়র্ক ও পেন্টাগনে হামলা যাত্রীবাহী বিমানের নয়, এটা ছিল ভেতর থেকেই সংঘটিত। নিউ ইয়র্ক টাইমসকে অধ্যাপক স্টিভেন বলেন, আফগান গুহায় বসে কিছু লোক এমন ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আমরা মনে করি না। সরকারের এ তত্ত্বকে আমরা চ্যালেঞ্জ করছি। টুইন টাওয়ারের ধ্বংস্তূপ পরীায় নিশ্চিত প্রমাণ মিলেছে ভবন ধসিয়ে দেয়ার বিস্ফোরক ব্যবহারের।
২৮-৯-২০০১ করাচির দৈনিক উম্মতের সাথে এক সাাৎকারে ওসামা বিন লাদেন বলেছিলেনÑ ইতঃপূর্বে বলেছি, ‘যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত ৯/১১ হামলায় জড়িত নই। মুসলিম হিসেবে যথাসম্ভব মিথ্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এ হামলাগুলো সম্পর্কে কোনো কিছুই জানতাম না। তা ছাড়া নিরীহ মহিলা, শিশু ও অন্যান্য মানুষের হত্যাকাণ্ডকে প্রশংসনীয় বিষয় বলে মনে করি না। নিরীহ মহিলা, শিশু ও অন্য লোকজনকে তি করা থেকে বিরত থাকার জন্য ইসলামের কঠোর নির্দেশ রয়েছে। যুদ্ধের েেত্রও এই নীতি প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্রই মহিলা, শিশু ও সাধারণ মানুষের সাথে সব ধরনের দুর্ব্যবহার করে থাকে। অনেকেই মনে করেন, বিন লাদেনকে আটক না করে হত্যা করা হয়েছে শুধু এ জন্য যে, তার বিচার হলে অনেক তথ্য বা রহস্য ফাঁস হয়ে যেত, যা কখনো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুখকর হওয়ার নয়। অনেকের অভিমত, বুশের নির্বাচনী আশ্বাস পেয়ে মুসলিম আমেরিকানরা একজোটে ভোট দিয়ে বুশকে মতায় আনে বিধায় তারা আর কখনো যাতে আমেরিকার মাটিতে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করতে না পারে, তা চিরস্থায়ীভাবে নিশ্চিত করার জন্য ঘটানো হয় ৯/১১-এর নারকীয় তাণ্ডব।
যুক্তরাষ্ট্রে এবার নতুন কৈশলে ৯/১১। যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম-বিদ্বেষ ছড়াতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে! মুসলমানদের প্রতি ভীতি ও ঘৃণা ছড়াতে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে। এমনই একটি ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে কাউন্সিল অব আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন (সিএআইআর) ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায়।
গত ২০ জুন ২০১৬ প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৭৪টি গ্রুপ এতে নিজেদের জড়িয়েছে। এদের মধ্যে আছে : নারীবাদী, খ্রিষ্টান, ইহুদি গ্রুপ, এমনকি প্রতিষ্ঠিত সংবাদ সংস্থাও। তারা কেউ দিয়েছে অর্থের জোগান, কেউ চালিয়েছে প্রপাগান্ডা।
সিএআইআরের মুখপাত্র উইলফ্রেডো আমর রুইজ আল-জাজিরাকে জানিয়েছেন, ‘এই কর্মকাণ্ডটি এখন একটি শিল্পের রূপ নিয়েছে। ইসলাম-বিদ্বেষ ছড়ানোর এ কাজ থেকে লাখ লাখ টাকা উপার্জন হচ্ছে। তারা কখনো কখনো নিজেদের ইসলামিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থাপন করছে।’
‘তারা এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করছে যেন, মুসলমানদের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। তারা আমেরিকানদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, মুসলমানরা আমেরিকান কমিউনিটির অংশ নয়। তারা আমেরিকার বিশ্বস্ত নাগরিকও নয়।’
রউজ বলছিলেন, এর দু’টি বিপজ্জনক দিক : একটি ঘৃণা থেকে অপরাধ বৃদ্ধি করছে এবং অন্যটি মুসলমানদের বিপে আইন প্রয়োগ হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ তিনি উল্লেখ করেছেন, গত এক বছরে শুধু ফোরিডাতেই মুসলিমবিরোধী অপরাধ বেড়েছে প্রায় ৫০০ গুণ। গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে মসজিদ। একাধিক ইসলামিক গ্রুপকে বোমা হামলার হুমকি দেয়া হয়েছে।‘ফোরিডার সরকারও স্কুলের পাঠ্যবই থেকে ইসলামের বিষয়াদি প্রত্যাহার করছেন।’ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৩ সালের পর থেকে মুসলিম ধর্মচর্চার নিন্দা জানিয়ে রাজ্যসভায় উত্থাপিত বিল বা সংশোধনীর সংখ্যা বেড়েছে। ফোরিডার একজন এমপি অ্যালান হায়েসের অভিযোগ, ‘আমাদের ধর্ম, রাজনীতি ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন ইসলাম এবং শরিয়াহ আইনের আক্রমণের মুখে। তারা আমাদের দেশকে পরাস্ত করতে চায়।’
মার্কিন থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর সোস্যাল পলিসি অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের (আইএসপিইউ) পরিচালক মেইরা নেগাজ বলছিলেন, গত মার্চে প্রকাশিত এক জরিপে দেখা যায়, আমেরিকার প্রতি পাঁচজনের একজন মুসলমানের নিয়মিত বৈষম্যের অভিজ্ঞতা রয়েছে, যাদের অর্ধেক বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছেন।
জরিপ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার।
মেইরা বলছিলেন, এ বৈষম্যের জন্য যতটা না সন্ত্রাসী ঘটনা দায়ী, তার চেয়ে বেশি যোগসূত্র রয়েছে রাজনীতির সাথে। নেগাজ জোর দিয়ে বলেন, এই ইসলাম-বিদ্বেষ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি এবং এর প্রভাব পড়বে দেশটির সব জনগোষ্ঠীর ওপর। হ
লেখক : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

No comments:

Post a Comment